বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। গোসল করা, কাপড় কাচাসহ বিভিন্ন কারণে পানি দূষিত হয়। বিভিন্ন কারণে পানি খর হয়। খর পানিকে বিভিন্ন উপায়ে আমরা মৃদু পানিতে পরিণত করতে পারি ।
পানির খরতা (Hardness of Water)
পানির উৎস হলো নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, সমুদ্র বা টিউবওয়েল ইত্যাদি। এসব পানিতে বিভিন্ন খনিজ লবণ দ্রবীভূত থাকতে পারে। পানিতে ক্যালসিয়াম বা ম্যাগনেসিয়ামের ক্লোরাইড, সালফেট, কার্বনেট বাইকার্বনেট ইত্যাদি লবণ দ্রবীভূত থাকলে উক্ত পানি সাবানের সাথে সহজে ফেনা উৎপন্ন করে না। এ ধরনের পানিকে খর পানি বলে। অবশ্য ক্যালসিয়াম বা ম্যাগনেসিয়াম ছাড়া আয়রন, ম্যঙ্গানিজ প্রভৃতি লবণ দ্রবীভূত থাকলেও পানি খর হতে পারে। খর পানিতে সাবান ঘষলে সহজে ফেনা উৎপাদন করে না কেন? কারণ সাবান হলো উচ্চতর জৈব এসিডের সোডিয়াম বা পটাশিয়াম লবণ। যেমন—সোডিয়াম স্টিয়ারেট (C17H35COONa) হলো স্টিয়ারিক এসিডের সোডিয়াম লবণ। এটি সাবান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ সাবান দিয়ে খর পানিতে কাপড় কাচা হলে যতক্ষণ পানিতে ক্যালসিয়াম বা ম্যাগনেসিয়ামের লবণ উপস্থিত থাকে ততক্ষণ ফেনা উৎপন্ন হয় না এবং সাবান ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে।
2C17H35COONa + CaCl2 (C17H35COO)2Ca + 2NaCl
ম্যাগনেসিয়াম বা অন্যান্য ধাতুর লবণও একই রূপ বিক্রিয়া করে। পানির পাইপ বা কলকারখানাতে বয়লারের ভিতরে খর পানি ব্যবহার করলে খর পানিতে বিদ্যমান বিভিন্ন খনিজ লবণ পাইপের গায়ে জমা হয়। ফলে পাইপের গায়ে মোটা আস্তরণ পড়ে। এতে পানির পাইপে পানি প্রবাহে বাধা পায়। বয়লারে তাপের অপচয় ঘটে এমনকি বয়লার ফেটে বিস্ফোরণ পর্যন্ত ঘটতে পারে। পানির মধ্যে যে ধর্মের জন্য পানিতে সাবান ভালোভাবে ময়লা পরিষ্কার করতে পারে না পানির সেই ধর্মকে পানির খরতা বলে। পানির খরতা দুই প্রকার, অস্থায়ী খরতা এবং স্থায়ী খরতা:
(i) অস্থায়ী খরতা: পানিতে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন প্রভৃতি ধাতুর বাইকার্বনেট (HCO3) লবণ দ্রবীভূত থাকলে যে খরতার সৃষ্টি হয় তাকে অস্থায়ী খরতা বলে এবং এই পানিকে অস্থায়ী খর পানি বলা হয়। অস্থায়ী খর পানিকে শুধু উত্তপ্ত করলেই অদ্রবণীয় কার্বনেট লবণ উৎপন্ন হয়। এ লবণ পাত্রের নিচে তলানি আকারে জমা হয়। এই তলানি থেকে ছাঁকনির মাধ্যমে পানিকে সহজেই পৃথক করা যায়। ফলে অস্থায়ী খরতা দূর হয় এবং অস্থায়ী খর পানি মৃদু পানিতে পরিণত হয়।
Ca(HCO3)2 Δ CaCO3 (s) + CO2(g) + H2O (1)
(ii) স্থায়ী খরতা: পানিতে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন প্রভৃতি ধাতুর ক্লোরাইড বা সালফেট লবণ দ্রবীভূত থাকলে স্থায়ী খরতার সৃষ্টি হয় এবং এই পানি স্থায়ী খর পানি বলে। স্থায়ী খর পানিকে শুধু উত্তপ্ত করলেই স্থায়ী খরতা দূরীভূত হয় না। বিভিন্ন বিক্রিয়ার মাধ্যমে বা বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে স্থায়ী খরতা দূর করা হয়। সাধারণত বদ্ধ জলাশয় যেমন—পুকুর, ডোবা ইত্যাদির পানি মৃদু হয়। বৃষ্টির পানিও মৃদু পানি। মৃদু পানিতে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন প্রভৃতি ধাতুর লবণ খুব বেশি দ্রবীভূত থাকে না। স্থায়ী খর পানি থেকে স্থায়ী খরতা অপসারণ করে ঐ পানিকে মৃদু পানিতে পরিণত হয়।
স্থায়ী খরতা দূরীকরণের পদ্ধতি: স্থায়ী খর পানির মধ্যে সোডিয়াম কার্বনেট যোগ করলে সোডিয়াম কার্বনেট ক্যালসিয়াম আয়ন ও ম্যাগনেসিয়াম আয়নের সাথে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম কার্বনেট এবং ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেটের অধঃক্ষেপ উৎপন্ন করে৷ ফলে পানি থেকে ক্যালসিয়াম আয়ন এবং ম্যাগনেশিয়াম আয়ন পানি থেকে অপসারিত হয় অর্থাৎ স্থায়ী খরতা দূর হয় ।
CaCl2 + Na2CO3 CaCO3 + 2NaCl
পানিদূষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ
পানিদূষণ উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহের বেশির ভাগই পানি। তাই প্রতিটি জীবের জন্য প্রচুর বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন। কিন্তু এই পানি নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। যেমন— গৃহস্থালি বর্জ্য বা মলমূত্র বৃষ্টির পানিতে বা অন্যভাবে ধুয়ে নদী, খাল-বিল, পুকুর প্রভৃতি জলাশয়ে এসে পড়ছে। এছাড়াও হাসপাতাল থেকে ওষুধপথ্য বা রোগীর বিভিন্ন ব্যবহার্য দ্রব্য ধুয়ে বিভিন্ন জলাশয়ের পানিতে এসে পড়ছে। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত সার ও কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুরের পানিতে এসে পড়ছে। শিল্পকারখানা থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য, বিভিন্ন যানবাহন থেকে বিশেষ করে জ্বালানি বর্জ্য পানিতে এসে পড়ে। ফলে পানি দুর্গন্ধযুক্ত ও বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। এসব বর্জ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের দূষক পদার্থের সাথে পানিতে লেড, ক্যাডমিয়াম, মার্কারি, ক্রোমিয়াম প্রভৃতি ভারী ধাতু মেশে। ভারী ধাতুগুলো মানুষের শরীরে ক্যানসারের মতো কঠিন রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
আবার মানুষের কর্মকাণ্ডে শুধু ভূ-পৃষ্ঠের পানি নয় ভূ-গর্ভস্থ পানিও দূষিত হচ্ছে। যেমন— অগভীর নলকূপের সাহায্যে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে এবং অতিরিক্ত খননের ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যায়। আর্সেনিক একটি বিষাক্ত পদার্থ। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার অতিরিক্ত আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ
আমাদের দেশে বড় শহরগুলোতে বর্জ্য শোধনাগার রয়েছে। তা আবার প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম৷ পয়ঃপ্রণালির বর্জ্য এবং গৃহস্থালির পচনশীল বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনের পাশাপাশি জৈব সার পাওয়া যায়। এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নিলে পরিবেশ ও পানি দূষণ হ্রাস পাবে। ছোট ছোট বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করলে মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র এবং গৃহস্থালির বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস ও জৈব সার পাওয়া যাবে, যা আমাদের জ্বালানি সংকট হ্রাস ও কৃষিক্ষেত্রে সারের খরচ কমাতে সাহায্য করবে।
প্রত্যেক শিল্পকারখানায় বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিবেশ বা উন্মুক্ত জলাশয়ে ফেলা যাবে না। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশে সংগঠিত জনসচেতনতা ও জনমতই দূষণ রোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় ।
পানির বিশুদ্ধতার পরীক্ষা ও বিশুদ্ধকরণ
বিশুদ্ধতার পরীক্ষা
বর্ণ ও গন্ধ পর্যবেক্ষণ: বিশুদ্ধ পানি বর্ণহীন ও গন্ধহীন স্বচ্ছ তরল পদার্থ। এতে সামান্য পরিমাণ খনিজ লবণ দ্রবীভূত থাকে। তবে কোনো কোনো খনিজ লবণ পানিতে অধিক পরিমাণ দ্রবীভূত থাকলে পানি দূষিত হয়। কোনো পানিতে গন্ধ পাওয়া গেলে বা ঘোলাটে দেখা গেলে অথবা ফিল্টার পেপারে ছাঁকা হলে তলানি পাওয়া গেলে পানি দূষিত।
পানির তাপমাত্রা: গ্রীষ্মকালে পানির তাপমাত্রা 30-35°C হয়। কখনো তা 40°C হতে পারে। কোনো কারণে পানির তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেশি হলে তাপ দূষণ হয়েছে বলা যায়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি ঠাণ্ডা করার পানি বা বয়লারের পানি সরাসরি জলাশয়ে মুক্ত করা হলে পানির তাপ দূষণ হয়। থার্মোমিটার দিয়ে পানির তাপমাত্রা নির্ণয় করে পানির তাপ দূষণ শনাক্ত করা যায়।
পানির pH মান: পানির pH মান 4.5 থেকে কম এবং 9.5 অপেক্ষা বেশি হলে তা জীবের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। pH পেপার বা pH মিটার ব্যবহার করে পানির pH এর মান নির্ণয় করা যায়।
BOD: BOD এর পূর্ণ রূপ হলো Biological Oxygen Demand। অর্থাৎ BOD এর বাংলা অর্থ হলো জৈব রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা। এক লিটার পানিতে উপস্থিত পচনযোগ্য জৈব দূষককে ব্যাকটেরিয়ার মতো অণুজীব দ্বারা ভাঙতে যে পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় তাকে উক্ত পানির BOD বলে। কোনো পানির BOD এর মান যত বেশি হয় সে পানি তত বেশি দূষিত হয়।
COD: COD এর পূর্ণরূপ হলো Chemical Oxygen Demand। অর্থাৎ COD এর বাংলা অর্থ হলো রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা। এক লিটার পানিতে উপস্থিত জৈব ও অজৈব দূষককে রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা ভাঙতে যে পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় তাকে উক্ত পানির COD বলে। কোনো পানির COD এর মান যত বেশি হয় সে পানি তত বেশি দূষিত হয়।
BOD ও COD উভয়ই পানির দূষণ মাত্রা প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়। কোনো পানির COD এর মান BOD অপেক্ষা বেশি হয়। কেননা, পানিতে উপস্থিত শুধু জৈব বস্তুকে ভাঙতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের পরিমাণ হলো BOD। অপরদিকে, সকল জৈব ও অজৈব দূষক তা অণুজীব দ্বারা পচনযোগ্য হোক বা না হোক তাদের রাসায়নিকভাবে সম্পূর্ণরূপে জারিত করতে যে পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় তাকে উক্ত পানির COD বলে। সুতরাং একই পানির COD এর মান BOD অপেক্ষা বেশি হবে।
পানি বিশুদ্ধকরণ
ক্লোরিনেশন (Chlorination) : পানিকে জীবাণুমুক্ত করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ক্লোরিনেশন। পানিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ব্লিচিং পাউডার যোগ করলে উৎপন্ন ক্লোরিন জারিত করার মাধ্যমে জীবাণুকে ধ্বংস করে। এ পদ্ধতিকে পানির ক্লোরিনেশন বলা হয়। এক্ষেত্রে পানিতে ব্লিচিং পাউডার যোগ করার পর ছেঁকে নিলে পানি পানযোগ্য হয়।
ফুটানো (Boiling): পানিকে কমপক্ষে 15 থেকে 20 মিনিট ধরে ফুটালে পানি জীবাণুমুক্ত হয়। তবে আর্সেনিকযুক্ত পানি ফুটালে তা আরও ক্ষতিকর হয়।
থিতানো (Sedimentation): এক বালতি পানিতে 1 চামচ ফিটকিরি (K2SO4. Al2(SO4)3, 24H2O) গুঁড়া যোগ করে আধা ঘণ্টা রেখে দিলে পানির সব অপদ্রব্য থিতিয়ে বালতির তলায় জমা হয়। তারপর উপর থেকে পানি ঢেলে পৃথক করা হয়। এভাবে অদ্রবণীয় দূষক দূর হয়।
ছাঁকন (Filtration): বর্তমানে বাজারে জীবাণু, আর্সেনিক ও অন্য দুখক দূর করতে ফিল্টার পাওয়া যাচ্ছে। এই ফিল্টার দিয়ে ছেঁকে নিলে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়।
আরও দেখুন...